সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:১৪ পূর্বাহ্ন
শাহীন হাসনাত:
পরিবেশ দূষণ নিয়ে গোটা বিশ্বে চলছে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা। বিশ্বের তাবৎ চিন্তাশীল মানুষ পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষার কৌশল নিয়ে অহর্নিশ তৎপর। পরিবেশ দূষণ বর্তমান সময়ে যেকোনো সময়ের তুলনায় ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে আজকের বিশ্ব উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করার দাবি করলেও পরিবেশ রক্ষায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। আজকালকার বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ উন্নতির ব্যাপারে যতটা না যতœবান, পরিবেশ রক্ষায় তেমন সচেতন নয়। ফলে আমাদের চারপাশ, সমাজ, এমনকি জীবন এক বীভৎস বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই পরিবেশ রক্ষায় গোটা দুনিয়ায় চলছে নানা গবেষণা, রচিত হচ্ছে অনেক ব্যয়বহুল পরিকল্পনা। প্রতিটি দেশের সমাজ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণে গলদঘর্ম প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। তাদের লক্ষ্য একটাই, কীভাবে দুনিয়াকে বসবাস করার উপযোগী রাখা যায়, কীভাবে পরিবেশ দূষণের অনিবার্য বিপর্যয় থেকে মানবতাকে রক্ষা করা যায়।
পরিবেশ দূষণের ফলে সমাজে চলছে ভাঙন ও বিশৃঙ্খলা, নষ্ট হচ্ছে জীবন ও সম্পদ, বাড়ছে অশান্তি ও অস্থিরতা। দূষণের কারণে রোগ-শোক, জরা-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে প্রতিনিয়ত কত মানুষ যে মৃত্যুর শীতল পরশ গ্রহণ করছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। দুনিয়ার মানুষ এখন বাঁচার তাগিদে পরিবেশকে রক্ষা করতে সর্বত্রই সোচ্চার হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশেও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের জোর সে্লাগান তুলছি।
এখন আমরা দেখি প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ নিয়ে ইসলামের কী নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহর নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই কী বলেন পরিবেশ নিয়ে। ইসলাম মনে করে, পরিবেশ মানুষের জন্য বড় এক নেয়ামত। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই পরিবেশ। চারপাশের অবস্থা, আকাশ-বাতাস, পানি-মাটি, গাছপালাসহ সম্প্রসারিত বিশাল দিগন্ত মিলে গড়ে উঠেছে আমাদের পরিবেশ।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ভাষায়, পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ওজোন স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত পরিমণ্ডলে বিদ্যমান আলো, বাতাস, পানি, মাটি, বন, পাহাড়, নদী, সাগর মোটকথা উদ্ভিদ ও জীবজগৎ সমন্বয়ে যা সৃষ্টি তাই পরিবেশ। পরিবেশ মহান আল্লাহতায়ালার মহান সৃষ্টি। মানুষের কল্যাণ ও স্বাভাবিক প্রয়োজনের তাগিদে পরিবেশের যাবতীয় জিনিস মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এর কোনোটাই অপ্রয়োজনে সৃষ্টি করা হয়নি। আল্লাহতায়ালা এ বিষয়ে কোরআনে কারিমের সুরা লোকমানের ২০ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন এভাবে, ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি দেখো না, নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের যা কিছু আছে সবই আল্লাহতায়ালা তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত রেখেছেন এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।’ সুরা আল বাকারার ২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন।’ একই বিষয়ে সুরা বাকারার ২২ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে পবিত্র সত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা ও আকাশকে ছাদস্বরূপ করে দিয়েছেন আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল ফসল উৎপন্ন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসেবে।’
উল্লিখিত কোরআনের আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, দুনিয়ার সৃষ্টি, উপায়-উপকরণ আমাদের জন্য পরম নেয়ামত। এগুলোর সংরক্ষণ, যথাযথ ব্যবহার, যতœ ও পরিচর্যা ইমানি দায়িত্বের অংশ। আমরা যদি এই পরিবেশকে রক্ষা না করি তা হলে আমাদের জন্য বিপর্যয় অবধারিত। বলা আবশ্যক, আজ দুনিয়াজুড়ে যে বিপর্যয় ও অশান্তি তা আমাদের নিজেদেরই তৈরি।
মানবতার নবী, বিশ্ব সম্প্রদায়ের অন্যতম কল্যাণকামী আদর্শ মানুষ হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের উত্তম জীবনধারণ ও কল্যাণ সাধনের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। উন্নত পরিবেশ তৈরিতে প্রিয়নবী ছিলেন বিশেষ যত্নবান। তাই নবী মুহাম্মদ (সা.) বৃক্ষ বা বন রক্ষার জন্য তাগিদ দিয়ে গেছেন সেই চৌদ্দশত বছর আগে। বৃক্ষ বা শস্য নষ্ট করাকে নিরুৎসাহিত করতে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন। জনৈক ব্যক্তি একটি গাছের পাতা ছিঁড়লে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘প্রত্যেকটি পাতা মহান আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে।’ বৃক্ষ রোপণকে উৎসাহিত করেছেন নবী করিম (সা.)। গাছপালা, লতা-পাতা মানুষ ও জীবজন্তুর জন্য খাদ্য সরবরাহ করে, মানুষ ও জীবের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে। গাছপালা ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রতিরোধ করে এবং মাটির ক্ষয়রোধ করে। এ প্রসঙ্গে নবীজি এক হাদিসে বলেছেন, হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষের চারা রোপণ করে অথবা ক্ষেতখামার করে, অতঃপর তা মানুষ, পাখি কোনো জন্তু ভক্ষণ করে, তা তার জন্য সদকার সওয়াব হবে।’ হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে, কেয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি লাগাবে।’
এভাবে পানি সংরক্ষণেও নবী করিম (সা.) বিশেষ নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। কারণ পানি মানুষ এবং জীব জগতের বেঁচে
থাকার সবচেয়ে বড় অবলম্বন। পানি ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। পানি দূষিত হলে মাটি, বায়ু ও খাদ্যও দূষিত হয়ে পড়ে। পানি দূষণের মূল কারণ হলো- নর্দমার ময়লা, কারখানার বর্জ্য পদার্থ, মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্র, কীটনাশকের মিশ্রণ প্রভৃতি। অতি প্রয়োজনীয় এবং জীবন ধারণের অন্যতম উপকরণ পানিকে বিশুদ্ধ রাখার জন্য পানির উৎস যেমন নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মহানবী (সা.)। তিনি পানিতে আবর্জনা মলমূত্র ও বর্জ্য ত্যাগ করতে নিষেধ করেছেন। নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা অভিশাপ আনয়নকারী তিন প্রকার কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখো। তা হলো- পানির উৎসসমূহে, রাস্তাঘাটে ও বৃক্ষের ছায়ায় মলমূত্র ত্যাগ করা।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমরা কেউ বদ্ধ পানিতে প্রসাব করে তাতে অজু কোরো না।’
বস্তুত পৃথিবীকে আবাসযোগ্য রাখতে, এর মধ্যকার জীব ও প্রাণীর সুস্থতা ও বেঁচে থাকার স্বার্থে এই ভূম-লীয় পরিবেশকে সংরক্ষণ করতে হবে। বর্তমানের এ লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডে গ্লাসগো শহরে জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত শীর্ষ সম্মেলন চলছে। সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশের নেতা। সম্মেলনে পরিবেশ রক্ষা, বেশি বেশি গাছ লাগানো, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা চলছে। আমরা মনে করি, পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব কেবলমাত্র সরকার কিংবা প্রশাসনের নয়- এটা বিশ্বের সব মানুষের, সব দেশের সব নাগরিকের। আর এ জন্য দরকার নাগরিক সচেতনতা। না হলে বছরের পর নানা সম্মেলন আর পরিকল্পনা কোনোটাই কাজে আসবে না। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের সেই সচেতনতা তৈরি হবে তো?
লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক।